বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে অহংকার করে
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১’র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জন ছাড়া গর্ব করার মতো বড় উপলক্ষ্য খুব কমই পেয়েছে বাংলাদেশ। আজো বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে অহংকার করে এ দুটিকে নিয়েই। দেশের সর্বস্তরে রাজনৈতিক মতভেদ। সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে যে কোন উৎসবেও রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাব। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কারণে দেশের মানুষ আশার চেয়ে হতাশাতেই ভোগেন বেশি। সামগ্রিকভাবে গোটা জাতির উৎসব, উপলক্ষ্য, উদযাপনের দৃশ্যও চোখে পড়ে না তেমন। এক দল বা মতার্দশের কাছে যেটি উৎসব-আনন্দ, অন্য দল ও মতাদর্শের কাছে সেটি বিষাদ হয়ে যায়। এমন দ্বিধা-বিভক্ত দেশ ও জাতিকে একই ছাতার নিচে নিয়ে এসেছে একমাত্র ক্রিকেট। সকল দল, মত, আদর্শের মানুষকে একই টেবিলে, একই ছাদের নিচে, একই রাস্তায় আনন্দ মিছিল করিয়েছে এই ক্রিকেট। পাশাপাশি শুধু দেশে নয়, গোটা বিশ্বে বাংলাদেশ, লাখ লাখ মানুষের রক্তে কেনা লাল-সবুজের পতাকাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে এই ক্রিকেটই।
৯৭’র আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে কেনিয়ার বিরুদ্ধে বিজয়, ৯৯’র বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তানকে হারিয়ে ক্রিকেটই গোটা দেশের মানুষকে উদযাপনের উপলক্ষ্য এনে দিয়েছিল। মাঝে নানা সময় আশার গান শুনিয়েছে, করেছে হতাশও। তারপরও সব ভুলে প্রতিটি ম্যাচের আগেই বুক ভরা আশা নিয়ে খেলা দেখতে বসেন ক্রিকেট প্রেমীরা। হোক সেটি জাতীয় ক্রিকেট দল, মহিলা ক্রিকেট দল কিংবা যুব ক্রিকেট দলের ম্যাচ। যেকোনো পর্যায়ের ক্রিকেটে জয় পেলেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন দেশের ১৭ কোটি মানুষ। শুভেচ্ছা জানান ক্রিকেটারদের।
কিন্তু দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্ব ক্রিকেটে অংশ নিয়ে বড় কোন অর্জন না থাকায় আক্ষেপ ছিল সকলের। জাতীয় ক্রিকেট দল ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল, এশিয়া কাপের ফাইনালের পর ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট ও ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালই ছিল দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় অর্জন। এর মাঝে মহিলা দল এশিয়া কাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশকে প্রথম কোন ট্রফি এনে দেয়। তবে বিশ্ব ক্রিকেটের বড় কোন ট্রফি না জেতার আক্ষেপে সব সময় পুড়েছে দেশের ক্রিকেট প্রেমী, ক্রিকেটাররা।
এই আক্ষেপ মেটাতে অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশ নিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি দেয় যুব ক্রিকেটাররা। লিগ পর্ব, কোয়াটার ফাইনাল, সেমিফাইনালে দাপটের সাথে ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশের যুবারা। কিন্তু প্রতিপক্ষের কারণে পুরো টুর্নামেন্টে দাপট দেখালেও মনের কোনে ভয় ও শঙ্কা কাজ করছিল। প্রতিপক্ষ ভারতও টুর্নামেন্টের অন্যতম হট ফেভারিট এবং প্রতিটি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অনৈতিক সুবিধা আদায় করতে অভ্যস্ত হওয়ায় এই শঙ্কা। আবার এই দেশটির সাথে বার বার পরাজিত হয়ে ট্রফি বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ।
কিন্তু ফাইনাল ম্যাচে সব ভয়-ভীতি, শঙ্কা উপেক্ষা করে শুরু থেকেই দাপটে ক্রিকেট খেলে বিশ্ব ক্রিকেটের প্রথম কোন ট্রফি ছিনিয়ে আনে অনুর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটাররা। সেই সাথে বাংলাদেশকে নতুনভাবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরলেন তারা।
দেশজুড়ে বিশ্বজয়ের আনন্দ: খেলার দিন গত রোববার দুপুর থেকেই দেশ-বিদেশের কোটি কোটি মানুষের চোখ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে। প্রতিপক্ষের আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরা একেকটি বল যখন ছুড়তে থাকেন বাংলাদেশের যুবারা এবং গতি, সুইং, স্পিনে পরাস্ত হয়ে যখন একেকটি উইকেটের পতন হচ্ছিল তখন উল্লাসে ফেটে পড়ছিলেন সারাদেশের মানুষ। প্রথম ইনিংসে ভারতকে মাত্র ১৭৭ রানে বেঁধে ফেলার পর থেকেই চলে বিশ্বজয় উদযাপনের প্রস্তুতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে জড়ো হতে থাকেন হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক, শিশু-কিশোর-বৃদ্ধসহ নানা শ্রেণি পেশার সব বয়সী নারী-পূরুষ। রাকিবুলের ব্যাট থেকে বিজয় সূচক রানটি আসার সাথে সাথে পচেফস্ট্রুমের বাউন্ডারির বাইরে থেকে ক্রিকেটাররা যেমন দ্বিগি¦দিক না তাকিয়ে দিয়েছেন ভোঁ দৌড় একই সময়ে উল্লাসে ফেটে পড়েন পচেফস্ট্রুমের গ্যালারি থেকে শুরু করে টিএসসির মিনি গ্যালারি, অলি-গলির চায়ের দোকান, যানজটে আটকে থাকা যাত্রী, ঘরের ভেতরে খেলা উপভোগ করা কোটি কোটি ক্রিকেট প্রেমী। বিশ্বজয়ের সাথে সাথে রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামেই জাতীয় পতাকা হাতে বিজয় মিছিল বের করেন তারা। দল, মত, পথ সকল ভেদাভেদ ভুলে তারা শ্লোগানে, শ্লোগানে শুভেচ্ছা জানান ক্রিকেটারদের।
জুনিয়র টাইগারদের প্রথম বারের মতো আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠে দলমত নির্বিশেষে সব ধরণের শিক্ষার্থীরা। জয়টা যখন প্রতিবেশি শক্তিশালী ভারতের বিরুদ্ধে তখন বাংলাদেশীদের আনন্দ যেন ধরে না। রোববার রাতে টিম টাইগার’সের জয়ের পর ঢাবি এলাকা উৎসবস্থলে পরিণত হয়। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, বাম বা প্রগতিশীল সব পরিচয় তুচ্ছ করে ভারতের সামনে বাংলাদেশি পরিচয়ে গর্বভরা স্লোগানে কেঁপে উঠে প্রাঙ্গণ। স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে জড় হন। কেউ বাঁশি বাজিয়ে, কেউ বাইকে করে শো-ডাউন দিয়ে অংশগ্রহণ করেন বিজয় উৎসবে।
শিক্ষার্থীরা বলেন, ভারত আইসিসিতে সব সময় প্রভাব বিস্তার করতে চায় যা আমরা এর আগে অনেকবার দেখেছি। এদিনটা বাংলাদেশীদের জন্য অনেক খুশির কারণ প্রভাবশালী ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জয় করেছি। এ ধরনের জয় আমাদের ক্রিকেটের ভবিষতের জন্য সুবার্তা বহন করে এবং আমরা আশা করি তাদের এই জয়ের ধারা অব্যহত থাকবে। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনাল জয়ের মাধ্যমে আমাদের জুবারা প্রমাণ করেছে ক্রিকেটের ইতিহাসে বাংলাদেশ কোন অঘটনের নাম নয়। বরং তারা ভালো ক্রিকেট খেলে সব বাধা অতিক্রম করতে পারে।
ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল হান্নান বলেন, বাংলাদেশের জয় আমাদের জন্য আনন্দের। আর সে জয় যদি ভারতের বিরুদ্ধে হয় তাহলে আনন্দের গণজোয়ার হাজির হয়। আয়তনের দিক থেকে আমরা ভারত থেকে কয়েকগুণ ছোট হলেও আমরা দেখিয়ে দিয়েছি বাংলাদেশীরা পারে না এখন আর এমন কোন কিছু অবশিষ্ট নাই। তাই ভারতের সামনে প্রমাণ হয়ে গেছে সবদিক থেকে বাংলাদেশ এখন একটি আতঙ্কের নাম। অন্যায় করে পার পাওয়া বা আয়তনে ছোট বলে প্রতিবেশির সম্পর্ককে তুচ্ছ করে দাদাগিরি করার দিন শেষ। আগামীদিনে অর্থনীতি, সুশাসনসহ সব দিক থেকে হিন্দুত্ববাদী মোদীর দোসরদের পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সেই কামনাই থাকবে। এক দিকে শহর জুড়ে যখন উৎসবের আমেজ, তখন টিএসসিতে এক দল তরুণের কণ্ঠে সমবেত সঙ্গীত ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ/ খুশির হাওয়া ঐ উড়ছে/ বাংলার ঘরে ঘরে/ মুক্তির আলো ঐ ঝরছে’। এই গানটিই স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় মুহূর্তে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত শেষ গান। আজ বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর ছুঁতে চলেছে, তখন বিশ্বকাপ হাতে সে দেশের যুব নাগরিকের কণ্ঠে গানটি যেন এক নতুন মাত্রা পেল।
বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর রাজধানীর গোপীবাগে মিছিল বের করে গত সিটি নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। তার সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ, দোকানদার, রিক্সাচালক সকলেই অংশ নেন। মিরপুরে স্টেডিয়াম এলাকায় শত শত যুবক পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে আনন্দ মিছিল করেন। টাইগারদের বিজয়ে রাজধানীর মিরপুরে কাউসার আহমেদ রোহান নামের এক টাইগার ভক্ত রাস্তায় মিষ্টি বিতরণ করেন। নয়াপল্টন এলাকায় রিক্সা চালক মিজান সারাদিনের উপার্জন দিয়ে মিস্টি কিনে বিতরণ করেন অন্য রিক্সা চালকদের মাঝে। কারওয়ান বাজারে মিছিল বের করে বাজারে কাজ করা কয়েকশ’ যুবক। এমন মিছিলে হাঁটা এক তরুণ অনিন্দ্য বললেন, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমরা জানান দিয়ে রাখলাম, ভবিষ্যতে বড়দের বিশ্বকাপও আমরা ঘরে আনবই। আর সেই দিন বেশি দূরে নেই।
একইভাবে সিলেটে জিন্দাবাজার এলাকা, রাজশাহীতে সাহেববাজার, যশোরের দড়াটানা মোড়, রংপুরের শাপলা চত্ত¡র, চট্টগ্রামে জিইসি মোড়সহ সারাদেশেই আনন্দ মিছিল বের করেন সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে রংপুরের মানুষের আনন্দে যোগ বাড়তি অনুপ্রেরণা, ঘরের ছেলে আকবরের নেতৃত্বে এ জয়ে খুশি রংপুরের মানুষ। জয় নিশ্চিত হবার পর থেকেই আনন্দ উল্লাসে উৎসবের নগরীতে পরিণত হয় রংপুর। পাড়া-মহল্লায় বের করা হয় আনন্দ মিছিল। উল্লাসের পাশাপাশি জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে খেলোয়ালদের প্রতি আহবান জানান উচ্ছ¡সিতরা।
সূএ :ইনকিলাব