24.4 C
Dhaka
January 30, 2025
Bangladesh

বর্ণে ছন্দে আনন্দে প্রাণের বৈশাখ

বর্ণে ছন্দে আনন্দে প্রাণের বৈশাখ

বর্ণে ছন্দে আনন্দে প্রাণের বৈশাখ

ফেলে আসা প্রতিটি দিন আমাদের জীবনের স্মৃতির আয়নায় জমে থাকে। পুরানো সব জীর্ণতাকে পিছনে ফেলে অনাবিল সুখ সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় রঙে রঙে স্বপ্নিল হয় আগত বছরের নতুন আশা ও আকাঙ্খা। তাই আবহমান বাংলার আত্মার পরম আত্মীয় হয়ে আছে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ। পহেলা বৈশাখে প্রতিটি বাঙালির ঘরে ঘরে থাকে উৎসবের আমেজ। মধ্যযুগে স¤্রাট আকবর তার শাসনামলে ১৫৮৪ সালের ১০ কিংবা ১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন। তার সিংহাসনে বসার পরের বছর প্রজাকল্যাণ আর খাজনা আদায়ের দিক লক্ষ্য রেখেই তিনি নতুন এ সালের প্রবর্তন করেন। তিনি তার রাজসভার জ্যোতির্বিদকে দিয়ে বিভিন্ন নক্ষত্রের নামানুসারে বাংলা ১২ মাসের নামকরণ করান।

বিশাখা নক্ষত্রের নামানুযায়ী বাংলা বছরের প্রথম ও শুরুর মাসের নাম রাখা হয় বৈশাখ। স¤্রাট আকবর যখন পহেলা বৈশাখ চালু করেছিলেন তখন এটি একটি কৃষিভিত্তিক দিন ছিল। মূলত খাজনা আদায় করার জন্যই পহেলা বৈশাখের জন্ম হয়েছিল। সে সময় কৃষকরাই ছিল এ পহেলা বৈশাখের আয়োজক। এতো বছর পরে এতোটুকু কমেনি পহেলা বৈশাখের গুরুত্ব। আবহমানকাল ধরে একই সুরে সুর মিলিয়ে সবাই বলে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো- তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক, এসো এসো।’ বৈশাখের প্রথম দিনে তন্বী তরুণীর খোঁপায় লাল ফুল। বৈশাখি বিকেলে তুমুল ঝড় আর ওই ঝড়ের মাঝেই কাজী নজরুল- জয়ধ্বনিতে নতুনের মিছিল- ‘ওই নূতনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখির ঝড়, তোরা সব জয়ধ্বনি কর। তোরা সব জয় ধ্বনি কর।’

নগরে ভোরের আলো ফুঁটে ওঠে- রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ গান- মাটির শানকিতে পান্তা ইলিশের সাথে কাঁচা মরিচ স্বাদে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউশনের ছাত্রছাত্রীদের রাজপথে বের করা মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্তমানে পহেলা বৈশাখের অন্যতম অনুষঙ্গ। এ মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ বিশ্ব স্বীকৃত একটি বিষয়। চারুকলা ইন্সটিটিউটের মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রা। জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেষ্কো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে তাদের ‘রিপ্রেজেনটেটিভ লিস্ট অব ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।ইউনেষ্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে মূল্যায়ন করেছে অন্যায় ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে সত্য, ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের মানুষের সাহসী সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের একই চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের বিষয়টিও ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই চারুকলার শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা চিত্র শিল্পীদের নিজস্ব প্রয়াসে এ শোভাযাত্রা হয়ে উঠেছে বিশ্বের ঐতিহ্য। আমাদের সংস্কৃতিকে করে তুলেছে ঋদ্ধ । এই মঙ্গল শোভাযাত্রা ১৯৮৯ সাল থেকে নিয়মিত হয়ে আসছে। চারুকলা অনুষদের ডিন ও শোভাযাত্রা শুরুর অন্যতম উদ্যোক্তা নিসার হোসেন ১৯৮৯ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। আসলে ১৯৮৫-৮৬ সালের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্যোক্তা।

বৈশাখী টানে উপমহাদেশের জনপ্রিয় শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গানে। সুরের ধারা ও চ্যানেল আই এর হাজারো কণ্ঠে বর্ষবরণ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র থেকে লাইভ সম্প্রচার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেখে বিশ্ববাঙালি জুড়ায় তাদের প্রাণ। শহরে ও গ্রামের ধুলো মাখা পথে মিছিলে মিছিলে চলা রঙ বেরঙের মুখোশ, কাগজের ফুল, পশু পাখির মুখ, কাগজের কারুতে নকশা আর আলপনায় পাড়া মহল্লা হুলস্থুল। গ্রামে বট অশ্বথ গাছের ছায়া শীতলে বৈশাখি রথের মেলা- খই, দই, মুড়ি, চিড়া, নাড়ু, নিমকি, সন্দেশ, দানাদার, রসকদম্ব, গুড়ের জিলাপি আর পাটালি কতোই না বাহারি খাবার। নাগরদোলা, পুতুল নাচ, বায়োষ্কোপ দেখা। বাউল লালন, হাসন রাজা, ঘেঁটু ও লেটো গান, জারি সারি ভাটিয়ালি, পালা গান, গম্ভীরারা সহ আরো কতো শতো গানের আসর। অভিনয় শিল্পীদের যাত্রাপালা। লাইলী মজনু, ইউসূফ জোলেখা আর রাধা কৃষ্ণের পালা দেখে এখনও কেঁদে বুক ভাসায় গ্রামের সহজ সরল মানুষ। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই পালার আসর।

পুরনো দিনে শহুরে বৈশাখি গানের কনসার্টে ফকির আলমগীর, ফেরদৗস ওয়াহিদের গানে টালমাটাল ছোট বড় সবাই। আর বর্তমান কালে রোদে পুড়ে বৈশাখি কনসার্টে নগর বাউল জেমস, হাসান, বিপ্লব, পার্থ বড়ুয়া আর ফিড ব্যাকের মাকসুদ এর ‘মেলায় যাইরে, বাসন্তি রঙ শাড়ি পড়ে ললনারা হেঁটে যায়, মেলায় যাইরে, বখাটে ছেলের ভিড়ে ললনাদের রেহাই নাই, মেলায় যাইরে, মেলায় যাইরে।’

বৈশাখে নতুন সিনেমা মুক্তির হিড়িক পড়ে। এক সময়ে দল বেঁধে সিনেমা হলে বাদাম খেতে খেতে কবরী, রাজ্জাক, ফারুক, ববিতা, শাবানা আর বুলবুল আহমেদের সিনেমা দেখা। আর হালে শহুরে জীবনের ফ্যাশনে এয়ার কন্ডিশন্ড সিনেপ্লেক্সে পপকর্ণ চিবোতে চিবোতে মৌসুমী, পূর্ণিমা, শাকিব খান, রিয়াজ আর পরীমণি’র বৈশাখী সিনেমা উপভোগ করা। পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে যাওয়া শপিং মল এর ফুডকোর্ট এ পান্তা ইলিশ এর সাথে ফুল ভলিউমে গান- ‘আইলো আইলো রে রঙ্গে ভরা বৈশাখ আবার আইলো রে, পাগলা মনে রঙ্গিন চোখে, নাগর দোলায় বছর ঘুরে একতারাটার সুরটা বুকে, হাজার তালের বাউল সুরে, দেশটা জুড়ে খুশির ঝড়ে একটা কথাই সবার মনে- আইলো আইলো রে- রঙ্গে ভরা বৈশাখ আবার আইলো রে।’ পরিবার নিয়ে শহরে বৈশাখ উদযাপনের মত গ্রামে বাড়িতে উঠোনে বসে খানা পিনা ও গানের আসর। বাহারি নানা রকমের রসের পিঠা স্বাদে বাড়ির ছেলে মেয়েরা নেচে ওঠে উৎসবের গানে- ‘বাজে রে বাজে ঢোল আর ঢাকা, এলো রে এলো পহেলা বৈশাখ।

আজি কৃষ্ণচ‚ড়ার ডালে লেগেছে লালে লালে, সেই রঙ হৃদয়ে ছড়াক। বাজে রে বাজে ঢোল আর ঢাকা, এলো রে এলো পহেলা বৈশাখ।’ বৈশাখী উৎসবে ষ্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগে রঙের ছোঁয়া- গান, আবৃত্তি, নাটক, ছবি আঁকা, লাঠিখেলা, ষাড়ের লড়াই, হাঁড়ি ভাঙা, কুস্তি, দৌড় প্রতিযোগিতা, মোরগ লড়াই, সাঁতার, ঘুড়ি প্রতিযোগিতা, ঘোড়াদৌড় ও নৌকাবাইচসহ আরো কতো কতো বাঙালি আয়োজন।

এই দিন ষ্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি বেসরকারি সব ধরণের প্রতিষ্ঠানে সরকারি ছুটি থাকে। তাই দিনটিতে সব বয়েসি মানুষ চুটিয়ে মজা করে। পহেলা বৈশাখে নাগরিক জীবনে সামাজিক ও সাংষ্কৃতিক সংগঠনগুলোর সদস্যরা তাদের পরিবারের জন্যে বনভোজনের আয়োজন করে।
এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখ প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়। আমাদের গ্রাম বাংলা এবং শহরের বাঙালি মানুষেরা এই দিনে নিজেদের ঘরবাড়ির সবকিছু ঘষে মেজে তকতকে ঝকঝকে করে। কারণ পহেলা বৈশাখ মানে নতুন জীবনের শুরু।

এই সময় তাই ব্যবসায়েরও শুভ সূচনা হয়ে থাকে। নানা ধরণের ছাড় এবং পণ্য ক্রয়ের অফার নিয়ে হাজির হয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো। শহরে জীবনে পহেলা বৈশাখে বাণিজ্যের পসরা বেশিই চোখে পড়ে।কর্পোরেট কালচার হাল আমলে বৈশাখের আনন্দে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। ব্যাংক বীমা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, গ্রæপ অব কোম্পানীজ, ব্যবসায়ি সংগঠন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমই, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, বিটিএমএ এবং রিহ্যাবসহ সকল বাণিজ্যিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান আলাদা আলাদাভাবে তাদের বৈশাখি উৎসব পালন করে। মোবাইল ফোন কোম্পানী গ্রামীণ ফোন, বাংলালিংক, এয়ারটেল, রবি এবং টেলিটকে থাকে বিভিন্ন অফার এবং নানা আয়োজন। নগর জীবনে বৈশাখী আনন্দে প্রতিবছর নতুন মাত্রা যোগ করেছে এসিআই মোটরর্স ইয়ামাহা। ইয়ামাহার বৈশাখী আয়োজনের প্রতি তরুণ প্রজন্মের থাকে বিশেষ আকর্ষণ। সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান হাসপাতালগুলোতেও বৈশাখি উৎসব পালিত হয় বেশ ঘটা করে। বিউটি পার্লারে বৈশাখি সাজ গোজ থেকে শুরু করে শপিং মল এবং বুটিক হাউজগুলো পোশাক কেনায় ধামাকা অফার নিয়ে হাজির হয়। ঘর সাজানোর সৌখিন পণ্য এবং ফ্রিজ টিভি এসি কেনায় দেওয়া হয় নগদ ছাড়।

আবাসন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো প্লট এবং ফ্ল্যাট বিক্রয়ে বৈশাখি আবাসন মেলা এবং বিশেষ ছাড় দেয়। এই সময়ে গণমাধ্যম জুড়ে পহেলা বৈশাখ। বাহারি সব বৈশাখী ফ্যাশন সংখ্যা বের করে পত্রিকা ও ম্যাগাজিনগুলো। বৈশাখি খাবারের রেসিপি নিয়ে প্রকাশিত হয় বিশেষ আয়োজন। ভোজন বিলাসি বাঙালি নারীদের কাছে বৈশাখের এর রেসিপি সংখ্যা খুবই জনপ্রিয়। পহেলা বৈশাখের আগাম বার্তা দিয়ে প্রচার প্রচারণায় নামে সম্প্রচার মাধ্যম। নিয়মিত খবর আর বুলেটিনের পাশাপাশি বিশেষ বৈশাখি গান, নাটক, সিনেমা, আড্ডা, আলোচনা ও বৈশাখি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাধ্যমে পরিবারের ছোট বড় সবার দৃষ্টি আটকে রাখে টিভি পর্দায়। শুধু বাংলাদেশ এবং ভারতজুড়েই নয় বৈশাখি আনন্দ এসে হাজির হয় বিশ্ববাঙালির দরজায়। এই দিন ছয়টি মহাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালিরা মেতে ওঠে আনন্দ উৎসবে এবং সারাবিশ্বে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতেও চলে আলোকসজ্জা এবং বৈশাখি উৎসব। আর বাংলাদেশের গ্রামে এবং শহরে নতুন বছরের হিসাব

পাকাপাকি টুকে রাখার জন্যে ব্যবসায়ীরা বছরের প্রথম দিনে আনকোরা নতুন একটি খাতা খোলে। যার নাম হাল খাতা। এই হালখাতা পহেলা বৈশাখে চিয়ারত বাঙালির প্রাণের উৎসব। পুরনো বছরের সব হিসাব নতুন খাতায় আবার নতুন করে শুরু হয়। হালখাতার দিন দোকানীরা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টি মন্ডা খেতে দিয়ে বিশেষভাবে আপ্যায়ন করে থাকেন। হালখাতার এই এই মিষ্টির স্বাদ মুখে নিয়ে আরেকটি নতুন বছর শুরু করে বিশ্ব বাঙালি। তাই উৎসবের সার্বজনীনতা বিবেচনায় নববর্ষ ধীরে ধীরে বাঙালি জীবনে ঈদ, পূজা, বড়দিন ও বৌদ্ধ পূর্ণিমার চেয়েও বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।

Related posts

ফ্রি ডাউনলোড বাংলা ভাষাতে সহিহ বুখারী অনুবাদ

Lutfur Mamun

করোনাভাইরাস আপডেট ও সর্বশেষ খবর || শনিবার, ১৩ মার্চ ২০২১ ||

Lutfur Mamun

৪০ চিকিৎসককে বদলি দুই দিনে চট্টগ্রামের

Lutfur Mamun

Leave a Comment